মাযহাব কি ও কেন

মাযহাব কি ও কেন?


     ☆মাযহাব একটি আরবী শব্দ। এর অর্থ- মত, মতবাদ, আদর্শ, চলার পথ ইত্যাদি। আল মু‘জামুল ওয়াসীত প্রণেতা বলেন- 
( المذهب ) الطريقة والمعتقد الذي يذهب إليه يقال ذهب مذهبا حسنا ويقال ما يدرى له مذهب أصل
 و( عند العلماء ) مجموعة من الآراء والنظريات العلمية والفلسفية ارتبط بعضها ببعض ارتباطا يجعلها وحدة منسقة
মাযহাব হলো নির্দিষ্ট পথ বা মত যার ওপর চলা হয়। যেমন বলা হয়, সে উত্তম পথে চলেছে। আরো বলা হয়- তার মূল মাযহাব জানা যায়না। আর উলামায়ে কিরামের নিকট মাযহাব হলো-
কিছু নির্দিষ্ট মতামত, আমলগত দৃষ্টিকোণ ও দর্শন, যা পরস্পর একে অপরের সাথে মিলে মিশে একটি দৃঢ় মতাদর্শে পরিণত হয়।[১] 
  
     ☆তাজুল আরূছ গ্রন্থকারের মতে-   
মাযহাব হলো- একটি মতাদর্শ যার ওপর পথ চলা হয়। আবার মাযহাব অর্থ হলো- পথ বা রাস্তা । যেমন বলা হয়- লোকটি সুন্দর মাযহাবে চললো অর্থাৎ, সুন্দর রাস্তায় চললো। আবার মাযহাব অর্থ হয়ে থাকে- মূল। যেমন লিহয়ানী কাসায়ী থেকে বর্ণনা করেছেন- তার মাযহাব কোথায় তা জানা যায়না। অর্থাৎ তার মূল কোথায় তা জানা যায়না।[২]   

     ☆পরিভাষায়- মাযহাব হলো মুজতাহিদ ইমাম কর্তৃক কুরআন-সুন্নাহ’র প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, সুস্পষ্ট, অস্পষ্ট ও পরস্পর বিরোধপূর্ণ জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করা এবং নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালার উপর ভিত্তি করে কুরআন-হাদীসের আলোকে নব উদ্ভূত সমস্যার প্রদত্ত সমাধান। সঠিকভাবে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপনের পন্থা। দ্বীন ও শরীয়তের গভীর জ্ঞান সম্পন্ন মুজতাহিদ ইমাম কর্তৃক কুরআন-সুন্নাহ’র প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, সুস্পষ্ট-অস্পষ্ট, পরস্পর বিরোধপূর্ণ জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা এবং নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে নব উদ্ভূত জীবন জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান।

     ☆তাকলীদ হলো কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করতে যেয়ে বিজ্ঞ মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদান করা মত বা মাযহাবকে কোনো প্রকার দলীল-প্রমাণ চাওয়া ব্যতিরেকে মেনে নেওয়া। মোটকথা মাযহাব মানে পথ, আর কোনো প্রকার সন্দেহ পোষণ না করে সে পথে চলাকে তাকলীদ বলে। যারা কুরআান সুন্নাহ’র গভীর জ্ঞান রাখেন না, তাদের জন্য নিজের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে তা বুঝতে না যেয়ে, যিনি গভীর জ্ঞান রাখেন, তাঁর জ্ঞানের আলোকে বুঝে নেওয়াই হলো যথোপযুক্ত কাজ, সহজ ও সঠিক পন্থা, এটাই কানূনে ইলাহী। সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতে মুসলিমা এ সহজ ও সঠিক পথেরই অণুসরণ করে আসছেন।
পৃথিবীর সকল মানুষই সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত নয়। যেমন জ্ঞানীদের মর্যাদা আল্লাহ তায়ালাই বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
বলুন! যারা জানে, আর যারা জানেনা তারা কি কখনোই সমান হতে পারে।[৩]  
     ☆আর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সুন্দর করে বলেই দিয়েছেন-
উলামায়ে কিরাম হলেন নবীদের উত্তরাধীকারী। [৪] 

এক কথায় বলা যায়, মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত্ব কুরআন-হাদীসের গবেষণালব্ধ ব্যাখ্যাকে মাযহাব বলে। 
মাযহাব অনুসরনের হুকুম

কুরআন-হাদীসের পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই, এমন ব্যক্তির জন্য মাযহাব মানা ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে  আল্লামা ইবনু আব্দিল বার র. (মৃ- ৪৬১হি.) বলেন-
فَإِنَّ الْعَامَّةَ لَا بُدَّ لَهَا مِنْ تَقْلِيدِ عُلَمَائِهَا 
নিশ্চয়ই সাধারণ (মুজতাহিদ নয়) মানুষের জন্য তাদের আলেমদের তাকলীদ করা আবশ্যক।[৫]  

     ☆আবার ইমাম গাযালী র. (৫০৫ হি.) বলেন-
العامي يجب عليه الاستفتاء  اتبباء العلماء
আম জনসাধারণের জন্য আলেমদের কাছে ফাত্ওয়া জিজ্ঞেস করা এবং তা মান্য করা ওয়াজিব।[৬] 

১. কুরআন কারীমের আলোকে

তাকলীদ নব আবিষ্কৃত কোনো বিষয় নয় বরং কুরআন কারীমে এ সম্পর্কিত মৌলিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। 
     ☆আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করো, আরো আনুগত্য করো তোমাদের  মধ্যে যারা ‘উলুল আমর’,  তাদের।[৭]  
প্রোক্ত আয়াতে কারীমায় ‘উলুল আমর’ বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে- এ সর্ম্পকে কারো কারো মত হলো- ‘উলুল আমর’ মুসলমান শাসকগণ। আবার কেউ কেউ বলেছেন- ‘উলুল আমর’ বলতে ফকীহগণকে বুঝানো হয়েছে।[৮]   
তবে ২য় মতটি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হযরত মুজাহিদ র., হযরত আতা ইবনে আবী রাবাহ র., হযরত আতা ইবনুস সাইব র., হযরত হাসান বসরী র. ও হযরত আবূল আলিয়া র. সহ বহু সংখ্যক মুফাসসিরীনে কিরাম হতে বর্ণিত হয়েছে। 
হযরত ইমাম রাযী  র. এই ২য় মতটিকে একাধিক দলীল-প্রমাণাদি দ্বারা প্রাধান্য দিয়েছেন। তারপর তিনি লিখেছেন- 
এই আয়াতে ‘উলুল আমর’ বলতে উলামায়ে কেরামকে বুঝানো হয়েছে, এটাই সঠিক মত।[৯]  
ইমাম আবূবকর জাছ্ছাস র. (মৃ-৩৭০ হি.) বলেছেন- এই দুটি তাফসীরের মধ্যে আসলে কোনো বিরোধ নেই; বরং উভয়টিই হতে পারে। এর ব্যাখ্যা হলো- রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শাসকদের আনুগত্য করা হবে। আর শরীয়াতের মাসাইলের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হবে আলিম ও ফকীহগণের।[১০]  
কেননা শাসকগণের আনুগত্যের শেষ ফল আলিমগণের আনুগত্যই দাঁড়ায়। কারণ, শাসকগণ ধর্মীয় বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে আলিমগণের অনুসরণ করে থাকেন। অতএব, শাসকদের অনুসরণ আলিমগণেরই অনুসরণ।
সারকথা, অত্র আয়াতে মুসলমানদের আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন আল্লাহ, তদীয় রাসূল এবং আলিম ও ফকীগণের অনুসরণ করে। কেননা আলিম ও ফকীহগণই হলেন আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় নবীর কালামের ব্যাখ্যাকার। আর এই সম্প্রদায়ের এই অনুসরণকেই ইসলামী পরিভাষায় তাকলীদ বলা হয়। চলবে..........
লেখক: মাও, মুহা, বদরুজ্জামান রিয়াদ।
 ‍মুহাদ্দিস, দারুন্নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা।
আরও পড়ুন: 




[১] ইবরাহীম মোস্তফা ও বন্ধুগণ আল মু‘জামূল ওয়াসীত, দারুদ দাওয়াহ,  খ- ১, পৃ- ৩১৭; 
[২]তাজুল আরূছ- খ- ২, পৃ- ৪৫০; 
[৩]সূরা যুমার- ৯; 
[৪]আবূ দাঊদ, আস সুনান-  ৩৬৪৩;
[৫]ইবনু আব্দিল বার, ইউসুফ ইবনে আব্দিল বার, (৪৬৩ হি.), জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহী,   (বৈরুত, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রকাশ- ১৩৯৮হি:),  খ- ২, পৃ- ৯৮৮
[৬]গাযালী,  আবূ হামিদ মুহাম্মদ ইবনু মুহাম্মদ গাযালী (৫০৫ হি:), আল মুসতাফতা,  খ-২, পৃ-১২৪;
[৭]সূরা নিসা- ৫৯,  
[৮]তাবারী, মুহাম্মদ ইবনে জারীর ইবনে ইয়াজিদ (৩১০ হি.), জামিউল বায়ান ফী তাবীলিল কুরআন,  (মুয়াস্সাসাতুর রিসালা, প্রথম প্রকাশ-১৪২০ হি.), খ- ৫, পৃ- ৮৮;
[৯] ফখরুদ্দীন রাযী, মুহাম্মদ ইবনে উমর (৬০৬ হি.), মাফাতীহুল গাইব,  (বৈরুত, দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবী), খ- ৩, পৃ- ৩৩৪; 
[১০] আবূ বকর জাছ্ছাস,  আহমদ ইবনে আলী (৩৭০ হি.), আহকামুল কুরআন, (বৈরুত, দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবী, প্রকাশকাল-১৪০৫ হি.), খ- ২, পৃ- ২৫৬;  

No comments:

Post a Comment