মসজিদে আকসার ইতিহাস

মসজিদে আকসার কান্না

মুসলমানদের প্রথম কিবলা বিখ্যাত ও প্রাচীন মসিজদ বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসা। যা ইসরাঈল ও ফিলিস্তিন সীমান্তে অবস্তিত জেরুজালেম নামক অতি প্রাচীন নগরীতে অধিকাংশ মানুষের নিকট এটি কুদস নামেও পরিচিত। ইসরাঈল ও ফিলিস্তিন দুটি রাষ্ট্রই জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী মনে করে যদিও বেশীরভাগই ফিলিস্তিনের আওতায় রয়েছে এবং যার ফলস্বরুপ নির্মাণ, পূণনির্মাণ, যুদ্ধ, শান্তিচুক্তি, দখল, ভুমিক্ম্প ইত্যাদির মত ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে মসজিদে আল আকসা। ধারণা করা হয়; মক্কা নগরী থেকে বেশ দুরে অবস্থিত বিধায় একে আকসা নামে ডাকা হয়।মহানবী (.) মিরাজের রাতে এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছিলেন। হযরত ইসা (আঃ)এর জন্মও এই জেরুজালেম শহরে। এছাড়াও অসংখ্য পয়গম্বরদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান এই বায়তুল মাকদাস। কুরআনে জেরুজালেম শহরকে বরকতময় ও পবিত্র ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ্ বলেন:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا
 “পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি,যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই।-সূরা বনি ইসরাইল: ১

 মসজিদে আকসার নির্মাণ
মসজিদে আকসার নির্মাণকাল নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।
আহলে কিতাবদের মতে: আল্লাহর নবী হযরত ইয়াকুব (আঃ) যাকে ইসরাঈল বলা হয়, তিনিই মসজিদে আকসার ভিত্তি স্থাপন করেন।(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
বলা হয়: হযরত সুলাইমান (আঃ) হযরত ইয়াকুব(আঃ) মসজিদটির নান্দনিক স্থাপনা তৈরি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন।
হাদিসে এসেছে: 
عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: «قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ مَسْجِدٍ وُضِعَ أَوَّلَ؟ قَالَ: الْمَسْجِدُ الْحَرَامُ. قُلْتُ: ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: الْمَسْجِدُ الْأَقْصَى. قُلْتُ: كَمْ بَيْنَهُمَا؟ قَالَ: أَرْبَعُونَ سَنَةً.
আবূ যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসূল! পৃথিবীতে কোন মসজিদটি সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছিল? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এরপর কোনটি। তিনি বললেন, আল মাসজিদুল আকসা বা বায়তুল মাকদিস। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, এ দু’টি মাসজিদের নির্মাণকালের মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। (সহীহ মুসলিম)।
এই হাদীসের বিবেচনায় বলা হয়: খ্রিষ্টপূর্ব ২১৭০ সালে কা’বা নির্মাণের চল্লিশ বছর পর এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) জেরুজালেমে একটি উপসনালয় তৈরী করেন এবং তাতে সবাই উপাসনা করতেন। আর পরবর্তীতে সংস্কারের মাধ্যমেই বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে সেখানে হেরড সেকেন্ড টেম্পল তৈরী করে। ইহুদীরা সুলাইমান আঃ এর বাইতুল মুকাদ্দাসকে সুলেমানের টেম্পল বলে। তাই হেরডের টেম্পলকে সেকেন্ড টেম্পল বলে। ইহুদীরা জেরুজালেমে হজ্বের মত করে আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। তাদের পূর্ব পুরুষদের মত মক্কায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেমে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেসময় এই মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এরপর নানান উত্থান-পতন হয় জেরুজালেমে। জেরুজালেম মুসলিম শাসনের আগ পর্যন্ত আর তার জৌলুশ খুঁজে পায়নি।

মুসলমানদের জেরুজালেম বিজয়:
৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সৈন্যরা জেরুজালেমের কাছাকাছি চলে আসে। তখন জেরুজালেমের দায়িত্বে ছিলেন বাইজেন্টাইন সরকারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় খ্রিস্টান গীর্জার প্রধানঃ যাজক সোফ্রোনিয়াস। খালিদ ইবন আল-ওয়ালিদ (রাঃ) এবং আম্র ইবন আল-আস্ (রাঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী শহর পরিবেষ্টন করা শুরু করলেও উমর (রাঃ) নিজে এসে আত্মসমর্পণ গ্রহণ না করলে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান যাজক সোফ্রোনিয়াস। এমন পরিস্থিতির খবর পেয়ে উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) একাই একটি উট এবং এক চাকরকে নিয়ে মদীনা ছেড়ে জেরুজালেমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। জেরুজালেমে সোফ্রোনিয়াস তাঁকে স্বাগত জানান। মুসলিমদের খলিফা, তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি উমর (রাঃ) ছিলেন খুব সাধারণ বুননের পোষাকে। তাঁকে ও ভৃত্যের মধ্যে কে উমর তা আলাদা করা যাচ্ছিলনা। এ অবস্থা দেখে সোফ্রোনিয়াস খুবই বিস্মিত হন।
এরপর উমর (রাঃ) কে পবিত্র সমাধির গীর্জাসহ পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখানো হয়। নামাজের সময় হলে সোফ্রোনিয়াস তাঁকে গীর্জার ভেতর নামাজ আদায় করার আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু উমর (রাঃ) তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, যদি তিনি সেখানে নামাজ আদায় করেন তাহলে পরবর্তীতে মুসলিমরা এই অজুহাত দেখিয়ে গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করবে – যা খ্রিস্টান সমাজকে তাদের একটি পবিত্র স্থান থেকে বঞ্চিত করবে। বরং উমর (রাঃ) গীর্জার বাইরে নামাজ আদায় করেন যেখানে পরবর্তীতে একটি মসজিদ নির্মিত হয় (যা “মসজিদে উমর” নামে পরিচিত)। এরপর হযরত ওমর (রা.) একটি চুক্তিনামা করেন; সেই সময় পর্যন্ত এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রগতিশীল চুক্তিগুলোর একটি। তুলনা করলে দেখা যায়, এ ঘটনার মাত্র ২৩ বছর আগেই পারসিকরা (পারস্যের অধিবাসী) বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে জেরুজালেম জয় করার পর জেরুজালেমের মানুষদের উপর গণহত্যা চালায়। একইভাবে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা মুসলিমদের থেকে জেরুজালেম দখল করার পর গণহত্যা চালায়।

বর্তমান আমরা যে স্থাপনাটি দেখি সেটি উমাইয়া যুগের। দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব প্রথম এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। খলিফা আবদুল মালিক ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করেন। সেসাথে তিনি কুব্বাত আস সাখরা নির্মাণ করেন। আবদুল মালিক মসজিদের কেন্দ্রীয় অক্ষ প্রায় ৪০ মিটার পশ্চিমে সরিয়ে আনেন যা হারাম আল শরিফ নিয়ে তার সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ ছিল। পুরনো অক্ষ একটি মিহরাব দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা “উমরের মিহরাব” বলে পরিচিত। কুব্বাত আস সাখরার উপর গুরুত্ব দিয়ে আবদুল মালিক তার স্থপতিদের দ্বারা নতুন মসজিদকে সাখরার সাথে এক সারিতে আনেন।

৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদুল আকসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর চার বছর পর আস-সাফাহ উমাইয়াদের উৎখাত করে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর ৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য তার সংকল্প ব্যক্ত করেন এবং ৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে তা সমাপ্ত হয়। ৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় একটি ভূমিকম্পের ফলে আল মনসুরের সংস্কারের সময়ের দক্ষিণ অংশ বাদে অনেক অংশ ধ্বংস হয়। ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে তার উত্তরসুরি খলিফা আল-মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন।
জেরুজালেমের পতন

১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করে নেয়। পুরো শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাইকারি হারে মুসলিমদের হত্যা করে। তারা আল আকসা মসজিদকে “সলোমনের মন্দির” এবং কুব্বাত আস সাখরাকে টেমপ্লাম ডোমিনি (ঈশ্বরের গম্বুজ) নাম দেয়। কুব্বাত আস সাখরা এসময় অগাস্টিনিয়ানদের তত্ত্বাবধানে গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়, আল-আকসা মসজিদকে রাজপ্রাসাদ ও পাশাপাশি ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১১১৯ খ্রিষ্টাব্দে আল আকসাকে খ্রিস্টানরা প্রশাসনিক কাজের জন্য ব্যবহার করে। এ সময় মসজিদে কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন করে খ্রিস্টানরা।



জেরুজালেম পুনরুদ্ধার
১১৬৭ সালে কুর্দি সেনাপতি সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে জেরুজালেম পুনরায় মুসলিমদের অধিকারে আসে। বিজয়ের পর মসজিদুল আকসায় কয়েকটি সংস্কার সাধিত হয়। জুমার নামাজের জন্য মসজিদকে প্রস্তুতের নিমিত্তে জেরুজালেম জয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে ক্রুসেডারদের স্থাপন করা টয়লেট ও শস্যের গুদাম সরিয়ে ফেলা হয়। মেঝে কার্পেটে আচ্ছাদিত করা হয়, এবং ভেতরের অংশ গোলাপজল এবং সুগণ্ধি দিয়ে সুগণ্ধযুক্ত করা হয়। সালাহউদ্দিনের পূর্বসূরি সুলতান নুরউদ্দিন জঙ্গি ১১৬৮-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে হাতির দাঁত ও কাঠ দিয়ে একটি মিম্বর নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন যা তার মৃত্যুর পর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। সুলতান নুরউদ্দিনের মিম্বরটি সালাহউদ্দিন আল আকসায় স্থাপন করেন। কুব্বাত আল সাখরার গম্বুজের উপরে খ্রিস্টানরা ক্রুশ চিহ্ন বসিয়েছিল। সুলতান আইয়ুবি সেখানে পুনরায় চাঁদ স্থাপন করেন। দামেস্কের আইয়ুবী সুলতান আল-মুয়াজ্জাম ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি ফটকসহ উত্তরের বারান্দা নির্মাণ করেন।

উসমানিয়া খিলাফত
উসমানিয়া খিলাফতের আমলে মূল মসজিদের কোন পরিবর্তন হয়নি। তবে এর আশে পাশে প্রচুর সৌন্দর্য বর্ধনকারী স্থাপনা তৈরী করা হয়। প্রথম সুলাইমানের শাসনামলে কুব্বাত আস সাখরাসহ আল আকসা বহির্ভাগ টাইলস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। এ কাজের জন্য সাত বছর সময় লাগে। অভ্যন্তরভাগ মোজাইক, ফাইয়েন্স ও মার্বেল দ্বারা সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। এর অধিকাংশই নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার কয়েকশত বছর পরে করা। এতে কুরআনের আয়াত লেখা রয়েছে। সূরা ইয়াসিন ও বনী ইসরাইল এতে খোদিত রয়েছে। ১৬২০ সালে কুব্বাত আস সাখরার পাশে উসমানীয়রা কুব্বাত আন নবী নামক আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ করে। ১৮১৭ সালে দ্বিতীয় মাহমুদের আমলে বড় ধরনের সংস্কার সম্পন্ন হয়।
আবার সংকট শুরু  
১৯১৭ সালে ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানিয়া খলিফা ছিলেন বৃটেন বিরোধী জোটে। তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন। যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান। উত্তর ছিল অর্থ নয় আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় বৃটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর বৃটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরব শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি।
ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
বৃটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় ফিলিস্তিনের দরজা, অন্যদিকে বৃটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর গণহত্যার কথা যখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হচ্ছিল তখন পরিস্থিতকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য গুপ্ত সংগঠন হাগানাহ বেছে নেয় আত্মহনন পন্থা। ১৯৪০ সালে এসএস প্যাট্রিয়া নামক একটি জাহাজকে হাইফা বন্দরে তারা উড়িয়ে দিয়ে ২৭৬ জন ইহুদিকে হত্যা করে। ১৯৪২ সালে আরেকটি জাহাজকে উড়িয়ে ৭৬৯ জন ইহুদিকে হত্যা করে৷ উভয় জাহাজে করে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসছিল আর বৃটিশরা সামরিক কৌশলগত কারণে জাহাজ দুটিকে ফিলিস্তিনের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছিল না। হাগানাহ এভাবে ইহুদিদের হত্যা করে বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করলো। পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে খুব দ্রুত। এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা দাড়ালো ৫ লাখ ৪০ হাজার। এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ হয় তাতে ৩৩টি রাষ্ট্র পক্ষে, ১৩টি বিরুদ্ধে এবং ১০টি ভোট দানে বিরত থাকে৷ প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনরা পেল ৪৩% তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত যাতে ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারে।
ফলে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত হলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রহসনের নাটকে জিতে গিয়ে ইহুদিরা হয়ে ওঠে আরো হিংস্র। তারা হত্যা সন্ত্রাসের পাশাপাশি ফিলিস্তিনদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতন করে মৃত্যু বিভীষিকা সৃষ্টি করতে লাগলো। ফলে লাখ লাখ আরব বাধ্য হলো দেশ ত্যাগ করতে। এরপরই ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করলো ইহুদিরা। ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিল, অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন-বৃটেন।
বর্তমান অবস্থা
ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা ইসরাঈল ১৯৬৭ সালে জেরুজালেম দখল করে। সেই সাথে আল আকসা মসজিদের নিয়ন্ত্রণ কার্যত তাদের হাতে চলে যায়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ছয় দিনের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত জর্ডানের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধায়ক ছিল। যুদ্ধে ইসরায়েল জয়ী হওয়ার পর ইসলামী ওয়াকফ ট্রাস্টের হাতে মসজিদের ভার প্রদান করা হয়। তবে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদ এলাকায় টহল ও তল্লাশি চালাতে পারে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের হামলার পর ওয়াকফ কর্তৃপক্ষ স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ ও কারিগরদের নিয়োগ করে নিয়মিত তত্ত্বাবধান কার্যক্রম চালায়। ইসরায়েলের ইসলামিক মুভমেন্ট এবং ওয়াকফ আল-আকসা ইন্তিফাদার পর থেকে হারাম আল শরিফে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চালিয়েছে।
মুহাম্মদ আহমেদ হুসাইন প্রধান ইমাম এবং আল-আকসা মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি দ্বন্দ্ব্বের ক্ষেত্রে আল-আকসা মসজিদের অধিকার একটি ইস্যু। মসজিদসহ পুরো হারাম আল শরিফের উপর ইসরায়েল তার সার্বভৌমত্ব দাবি করে কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দাবি এর অভিভাবকত্ব ইসলামি ওয়াকফের। ২০০০ ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনে আলোচনায় ফিলিস্তিনিরা মসজিদ এবং পূর্ব জেরুজালেমের অন্যান্য ইসলামি স্থানগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করে।
সর্বশেষে: গত মঙ্গলবার সারা বিশ্বের মতামত ও হুমকি উপেক্ষা করে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে। 

আরও পড়ুন: 


1 comment: