ইসলামে গৃহকর্মীর অধিকার : ১ম পর্ব

ইসলামী শরীয়তে গৃহকর্মীর অধিকার
  
ড. মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আজহারী


সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। অগণিত দরুদ ও সালাম বিশ^মানবতার মুক্তিরদূত হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওপর। যার অন্তিম যাত্রার শেষ উপদেশ ছিল: "তোমরা তোমাদের গৃহকর্মীদের (ক্রীতদাস, চাকর ও কর্মচারী) ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।"1  "তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করো।"2  কেননা, "তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার দূর্ভাগ্যের কারণ।"3  আর এ শ্রেণীর মানুষদের প্রতি ইনসাফ কায়েম করা ছিল  তাঁর দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুয়্যতী জীবনের দাওয়াতী মিশনের অর্ন্তভূক্ত। আদিকাল থেকে তাদের ওপর চলে আসা সকল অত্যাচার ও নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে ইসলাম তাদেরকে ভ্রাতৃত্বের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। শুধু তাই নয়; ইসলামের সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিনের মর্যাদা দান করা হয়েছে ক্রীতদাস হযরত বেলাল বিন রবাহ (রা.) কে। হাদীসে এসেছে: "তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধিনস্ত করে দিয়েছেন।"4   তাদের প্রতি অবিচার করা হলে তার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে। 

        ➤গৃহকর্মীর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন: 

أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا، وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ 

"জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই স্বীয় গৃহকর্মীর  সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব শাসক যিনি তার জনগণের দায়িত্বশীল; তিনি তার গৃহকর্মীর  ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার গৃহকর্মীর  ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্তুতির ওপর দায়িত্বশীল; সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। দাস তার মনিবের সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক; তাকে উহা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মনে রেখ! তোমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে তত্ত্বাবধায়ক ও সংরক্ষক। তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।"5  

       ➤তাই ইসলামের দৃষ্টিতে অধিনস্ত ক্রীতদাস, চাকর ও কর্মচারীদের অধিকারগুলো হলো: 


      1. কাজ-কর্মে কঠোরতা ও তিরস্কার না করে সহমর্মিতা প্রদর্শন করা: 

জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর মাঝে রয়েছে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি অধিনস্ত ক্রীতদাসের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি সর্বদা তাদের প্রয়োজন পূরণ করতেন। কাজে কর্মে তাদের কৃত ভুল-ক্রুটির জন্য রাগ ও তিরস্কার করতেন না। হাদীসে এসেছে: হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন:

خَدَمْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَشْرَ سِنِينَ وَاللَّهِ مَا قَالَ لِى أُفًّا. قَطُّ وَلاَ قَالَ لِى لِشَىْءٍ لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَهَلاَّ فَعَلْتَ كَذَا.

"আমি দশ বছর যাবৎ রাসুল (দ.) এর সেবা করেছিলাম। আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আমার বেলায় আহ শব্দটি উচ্চারণ করেননি (অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করেননি)। অথবা কখনো আমাকে কোন কাজের জন্য এতটুকুও বলেননি যে: কেন এমনটা করেছ? কেন এমন করনি?"6
  
        ➤ হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) আরো বলেন: 

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ خُلُقًا فَأَرْسَلَنِى يَوْمًا لِحَاجَةٍ فَقُلْتُ وَاللَّهِ لاَ أَذْهَبُ. وَفِى نَفْسِى أَنْ أَذْهَبَ لِمَا أَمَرَنِى بِهِ نَبِىُّ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَخَرَجْتُ حَتَّى أَمُرَّ عَلَى صِبْيَانٍ وَهُمْ يَلْعَبُونَ فِى السُّوقِ فَإِذَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَدْ قَبَضَ بِقَفَاىَ مِنْ وَرَائِى - قَالَ - فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ وَهُوَ يَضْحَكُ فَقَالَ « يَا أُنَيْسُ أَذَهَبْتَ حَيْثُ أَمَرْتُكَ ». قَالَ قُلْتُ نَعَمْ أَنَا أَذْهَبُ يَا رَسُولَ اللَّهِ.

"একদিন রাসুল (দ.) আমাকে কোন কাজে পাঠাতে চাইলে আমি বললাম: আল্লাহর কসম! আমি যেতে পারবো না। অথচ মনে মনে ঠিক করেছি যে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসুল আমাকে যে কাজের আদেশ করেছেন সে কাজে যাব। এ মনোভাব নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। পথিমধ্যে একদল বালকের কাছে পৌছলাম যারা বাজারে খেল-তামাশা করছে। এমন সময় হঠাৎ রাসুল (দ.) আমার ঘাড়ে চেপে ধরলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম তিনি হাসছেন। তারপর বললেন: প্রিয় আনাস! আমি তোমাকে যেখানে যাওয়ার আদেশ করেছিলাম সেখানে গিয়েছ? আমি বললাম: হ্যা আল্লাহর রাসুল আমি যাচ্ছি।"7


      2.গৃহকর্মীর কে সদুপদেশ দেওয়া ও তাদের মতামতকে মূল্যায়ন করা:

ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মানুষ হয়েও তারা মানুষের অধিনস্ত দাসে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনচেতা মানুষের মত নিজের ভালো ও কল্যাণকর বিষয়গুলো নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তার অধিকার রয়েছে। তাই মনিবদের উচিত সর্বদা তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া এবং তাদের আপন বিষয়ে স্বীয় মতামতকে সম্মান ও প্রাধান্য দেওয়া। অনিচ্ছাকৃত কোন সিদ্ধান্ত ও বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। হাদীসে এসেছে: উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) এর একজন চাকরাণীর নাম ছিল: বারীরা। বারিরাকে আযাদ করার পর সে তার স্বামী ক্রীতদাস মুগিছকে তালাক দিতে চাইলো। কিন্তু, মুগিছ তার পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে। এ অবস্থা দেখে রাসুল (দ.) বারীরাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: 

«لَوْ رَاجَعْتِهِ» قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ تَأْمُرُنِي؟ قَالَ: «إِنَّمَا أَنَا أَشْفَعُ» قَالَتْ: لاَ حَاجَةَ لِي فِيهِ.

"(বারীরা) তুমি যদি তার কাছে আবার ফিরে যেতে! সে বলল: ওহে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে আদেশ করছেন? তিনি বললেন: আমি সুপারিশ করছি মাত্র। তখন বারীরা বলল: তাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই।"8
  

      3.গৃহকর্মীর কে মারধর ও অপমান না করা: 

সভ্যতার উৎকর্ষে আমাদের বর্তমান সময়ে মানবতা বিলিন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই পত্র-পত্রিকাতে দেখা যায় যে, বাসার চাকরদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হচ্ছে। তাদেরকে ঠিকমত অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান দেওয়া হচ্ছে না। যেন আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগের আবির্ভাব হচ্ছে। অথচ শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবতার ধর্ম ইসলামে গৃহকর্মীর কে মারধর ও অপমান করতে নিষেধ করা হয়েছে। বিশ^ মানবতার মুক্তিরদূত রাসুল (দ.) কখনো কোন ক্রীতদাসকে মারধর করেননি। হাদীসে এসেছে: উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন:

مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ وَلاَ امْرَأَةً وَلاَ خَادِمًا إِلاَّ أَنْ يُجَاهِدَ فِى سَبِيلِ اللَّهِ.

"রাসুল (দ.) কোনদিন কাউকে নিজ হাতে প্রহার করেননি। এমনকি কোন মহিলা ও খাদেমকেও মারধর করেননি। কেবল মাত্র আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়েছে।"9 

     ➤হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একদা রাসুল (দ.) দুইজন চাকর নিয়ে আসলেন। একজনকে হযরত আলী (রা.) কে দিলেন। তখন তিনি বলেন:

 لَا تَضْرِبْهُ فَإِنِّي نُهِيت عَنْ ضَرْبِ أَهْلِ الصَّلَاةِ  

"দেখ! তাকে মারধর করবে না। কেননা, নামাযীকে মারধর করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন।"10 


আরো পড়ুন:




                                                                          
  ১. ইমাম আবু দাঊদ সুলাইমান ইবনুল আসয়াছ ইবনে ইবনে ইসহাক আল্ আযদী সিজিস্তানী র, ওফাত: ২৭৫ হিঃ, السنن, (আল মাকতাবাতুল আসরিয়া: বইরুত), ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৩৩৯, হাদীস নং: ৫১৫৬।
 ২.  আবুত তাইয়্যেব মুহাম্মদ শামসুল হক্ক আল্ আজিম আবাদি, عون المعبود, (দারুল কুতুবিল ইলমিয়া: বইরুত, ১৪১৫ হিঃ), ৩য় সংস্করণ, ১৪তম খন্ড, পৃ: ৪৪।
 ৩. প্রাগুক্ত,  السنن, (আল মাকতাবাতুল আসরিয়া: বইরুত), ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৩৪১, হাদীস নং: ৫১৬২।
 ৪.  ইমাম বুখারী আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল র, ওফাত:২৫৬ হিঃ, الجامع المسند الصحيح المختصر, (দারু ত্বওকুন নাজাত: বইরুত, ১৪২২ হিঃ), ১ম সংস্করণ, ৮ম খন্ড, পৃ: ১৬, হাদীস নং: ৬০৫০। 
 ৫. الجامع المسند الصحيح المختصر, (দারু ত্বওকুন নাজাত: বইরুত, ১৪২২ হিঃ), ১ম সংস্করণ, ৯ম খন্ড, পৃ: ৬২, হাদীস নং: ৭১৩৮।
 ৬.  ইমাম মুসলিম, আবুল হাসান মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন্ নিসাপুরী র, ওফাত: ২৬১ হিঃ, الجامع الصحيح, (দারু ইহইয়ায়িত তুরাছিল আরবি: বইরুত), ৪র্থ খন্ড, পৃ: ১৮০৪, হাদীস নং: ২৩০৯।
 ৭.  প্রাগুক্ত, পৃ: ১৮০৫, হাদীস নং: ২৩১০।
 ৮.  ইমাম বুখারী র, الجامع المسند الصحيح المختصر, (দারু ত্বওকুন নাজাত: বইরুত, ১৪২২ হিঃ), ১ম সংস্করণ, ৭ম খন্ড, পৃ:৪৮, হাদীস নং: ৫২৮৩। 
 ৯. ইমাম মুসলিম র, الجامع الصحيح, (দারুণ আফাকিল জাদীদাহ: বইরুত), ৭র্ম খন্ড, পৃ: ৮০, হাদীস নং: ৬১৯৫।
১০. ইমাম বুখারী র, الأدب المفرد, (মাকতাবাতুল মায়ারিফ লিন নাসর ওয়াত তাওযি: রিয়াদ, ১৪১৯ হিঃ), ১ম সংস্করণ, পৃ: ৮৮, হাদীস নং: ১৬২।

No comments:

Post a Comment