ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের দলীল

মূল: ড. মোঃ সাইফুল ইসলাম
ভাষান্তরে: মোঃ হাবীবুর রহমান

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর, যার দয়া ও করুণা অপার। অসংখ্য দরুদ ও সালাম সৃষ্টিরকুলের মুক্তিরদূত হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর প্রতি। আরও সালাম তাঁর পূতপবিত্র আহলে বাইত, হেদায়াতের সিতারা সাহাবাগণের প্রতি। এ ধরায় মুহাম্মদ (দ.) এর আগমন সমগ্র সৃষ্টির জন্য ঐশ্বরিক রহমতের অভিব্যক্তি ছিল। তাই তাঁর আগমনের দিন ১২-ই রবিউল আউয়াল সোমবার উপলক্ষ্যে 'মীলাদুন্নবী উদযাপন মূলতঃ মানুষদের সমবেত করা, কুরআনের অংশ-বিশেষ তিলাওয়াত, মহানবী (দ.) এর ধরাধামে শুভাগমন সংক্রান্ত ঘটনা ও লক্ষ্মণগুলোর বর্ণনা পেশ, অতঃপর তবাররুক (খাবার) বিতরণ এবং সবশেষে সমাবেশ ত্যাগ, তা উত্তম বেদআত (উদ্ভাবন); আর যে ব্যক্তি এর অনুশীলন করেন তিনি সওয়াব অর্জন করেন, কেননা এতে জড়িত রয়েছে রাসূলুল্লাহ (দ.) এর মহান র্মযাদার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রর্দশন এবং তাঁর সম্মানিত বেলাদাতের প্রতি খুশি প্রকাশ।'
রাসুল (দ.) এর প্রতি ভালোবাসারই বহিপ্রকাশ এবং আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাকে ভালোবাসা আমাদের ওপর আবশ্যক করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন:

 .النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِم

নবী মু’মিনদের নিকট তাদের নিজেদের চেয়ে অধিক ঘনিষ্ঠ।   (সুরা আহযাব : ০৬) 
হাদীস শরীফও ইহার সত্যায়ন করেছে যে, আল্লাহর নবীর ভালোবাসা ঈমানের জন্য আবশ্যক। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম র. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একবার হযরত ওমর (রা.) রাসুল (দ.) কে বললেন : 'হে আল্লাহর রাসুল, নিশ্চয়ই আপনি আমার কাছে আমার নিজ সত্তা ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে বেশী প্রিয়।' তখন রাসুল (সা.) বললেন, কোনো ব্যক্তির কাছে যতক্ষণ আমি তার নিজ সত্তা অপেক্ষা বেশী প্রিয় না হব, ততক্ষণ র্পযন্ত সে মুমনি হতে পারবে না। অতঃপর ওমর বললনে, 'আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে নিজ সত্তা অপেক্ষা বেশী প্রিয়।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে ওমর, এখন তুমি (মুমিন হলে)।  অতএব, মিলাদুন্নবীর আনুষ্ঠানিকতা মূলত তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। আর তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ধর্মীয়ভাবেই আবশ্যকী বিষয়। কেননা, এটাই মূল স্তম্ভ এবং উত্তম অবলম্বন।

    ☆সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী উদাযাপনকারী সম্পর্কে আল্লামা ইবনে কাছীর (র.) البداية والنهاية  নামক ইতিহাসের কিতাবে বলেন: মালেক মুজাফ্ফর আবু সাঈদ বিন জয়নুদ্দিন (আরবলের বাদশাহ)। তিনি প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাসে স্বীয় শহরে জৌলুসর্পূণভাবে বিরাট মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করতেন। তথায় বহু সুফী, আলেম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকতেন। তিনি একজন বেনজির বীর, আলেম, বিচারক ছিলেন। মিলাদুন্নবী সম্পর্কে সর্বপ্রথম কিতাব রচনা করেন ইবনে দাহিয়াহ (র.) যার নাম ছিল : التنوير بمولد البشير النذير এবং এর জন্য তাকে একহাজার দিনার উপঢৌকন দেওয়া হয়। (তাফসীরে রুহুল বায়ান, ইসমাঈল হাক্কী র., প্রকাশক : দারুল ফিকর; বইরুত, তাফসীরে সুরা ফাতহ, ৯ম খন্ড, পৃঃ ৫৬)

      কোরআনের আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবী:

    ☆আল্লাহ বলেন:
  .قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ

বল, আল্লাহর দয়া ও মেহেরবাণীতে। সুতরাং এরই প্রতি তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। এটিই উত্তম সে সমুদয় থেকে যা সঞ্চয় করছ।(সুরা ইউনুস : ৫৮)  
আর নবী করিম (দ.) হলেন হেদায়াতের রহমত। যেমন নস এসেছে :

  .وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ

আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সুরা ইউনুস : ৫৮)  
নবী করিম (দ.) এর জন্মদিন উদযাপন করা আনন্দ ও ভালোবাসারই প্রকাশমাত্র। সুতরা মিলাদুন্নবী উদযাপান করা আদিষ্ট গন্ডীর ভিতরেই রয়েছে এবং এটা সর্বোত্তম। আর আনন্দ ও খুশি প্রকাশের তরে আনুষ্ঠানিকতা, এটা সবার কাছে খুব প্রচলিতরীতিই। যেমনিভাবে বিবাহ, ওলিমা, আকিকাসহ অন্যান্য কাজের আনুষ্ঠানিক বিধান ত্যাগ বা গোপন করা যায়না। এ ছাড়া আরোও আয়াত রয়েছে যেগুলো মিলাদুন্নবী উদযাপনের বিধানকে সাব্যস্ত করে। যদি এ ব্যাপারে স্পষ্ট আয়াত নেই, তাতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা, অসংখ্য ফিকহী মাসাআলা রয়েছে যার ব্যাপারে নসসে সরীহ নেই।  

      হাদীসে ঈদে মিলাদুন্নবী:

    ☆হযরত আবু কাতাদাহ (রা.) খেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ (দ.) কে সোমবার দিনে রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন :

    فيه ولدت، وفيه أنزل علي 

এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম এবং এই দিনেই আমার ওপর অহী অবতীর্ণ হয়। (সহীহ মুসলিম  كتاب الصوم, ২য় খন্ড/ পৃষ্ঠা: ৮১৯। হাদীস নং ১১৬২)
দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহর রাসুল (দ.) নিজেই তার জন্মদিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আর এ সম্মান প্রকাশিত হয়েছে রোযার দ্বারা। এ হাদীসে মিলাদুন্নবী উদযাপনকে কেবল রোযা রাখার দ্বারাই সীমাবদ্ধ করা হয়নি, বরং যাবতীয় ইবাদতের মাধ্যমেও তা উদযাপন করা যাবে।

    ☆হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন :

 .أن النبى صلى الله عليه وسلم عقَّ عن نفسه بعد النبوة

নবী করিম (দ.) নবুয়্যতের পর নিজের পক্ষ থেকে আকীকা করেছেন। (আবু বকর আল বায়হাকী র, السنن الكبري, প্রকাশক: দারুল কুতুবিল ইলমিয়া; লেবানন; বাইরুত, ২০০৩ সাল, كتاب الضحايا، ৯ম খন্ড/ পৃষ্ঠা : ৫০৫. হাদীস নং ১৯২৭৩।)

ইসলামি শরীয়ার প্রসিদ্ধ সুত্র হলো : "আকীকা দ্বিতীয়বার গণ্য করা হয় না।" অর্থাৎ আকীকা একবারই করা হয়। কেননা, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী র. উক্ত হাদীস আনায়নের পর উল্লেখ করেন যে, নিশ্চয়ই নবী করিম (দ.) এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর জন্মের ৭ম দিনে আকীকা সম্পন্ন করেছিলেন। আর আকীকা দুইবার হয় না। সুতরাং এ থেকে বুঝা গেল যে, নবী করিম (দ.) কে বিশ^বাসীর জন্য রহমতস্বরুপ প্রেরণ এবং তাঁর উম্মতের জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করায় আল্লাহর শুকরজ্ঞাপনের নিমিত্তে তিনি নিজের জন্য এসব করেছেন।  (الحاوي للفتاوي, প্রকাশক : দারুল ফিকর; লেবানন; বইরুত, প্রকাশকাল: ২০০৪ সাল, ১ম খন্ড/ পৃ: ২৩০।)

 বিভ্রান্তির নিরসন :   

প্রশ্ন করা হয়ে থাকে যে, ১২ ই রবিউল আউয়াল তথা এ মাস হলো আল্লাহর রাসুল (দ.) এর জন্মের মাস এবং ওফাতের মাসও। তো মিলাদুন্নবী তথা খুশি প্রকাশের সাথে সাথে শোক কেন প্রকাশ করা হয় না?
    জবাব - এই প্রশ্নের জবাবে ইমাম হাফেজ সুয়ুতী (র.) الحاوى للفتاوى  (১ম খন্ড/ পৃঃ  ২২৬কিতাবে বলেন :

'নিশ্চয়ই নবী করিম (দ.) এর জন্ম বা মিলাদ আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় নেয়ামত এবং তাঁর ওফাত আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় মুসিবত। আর ইসলামী শরীয়ত নেয়ামত লাভের জন্য শুকরিয়া আদায়ের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিয়েছে এবং বিপদে ধৈর্যধারণ, স্থির থাকা ও তা গোপন রাখরা প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। শরীয়ত নবজাত শিশুর জন্য খুশি ও শুকরের নিমিত্তে আকীকা করার নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু; মৃতের জন্য পশু যবেহ করার নির্দেশ দেয়নি। বরং মৃতের জন্য বিলাপ ও দুঃখ প্রকাশ করতে নিষেধ করেছে। সুতরাং ইসলামী শরীয়তের বিধান এ মর্মে দালালত করে যে, রাসুলুল্লাহ (দ.) এর মিলাদ উপলক্ষ্যে এ মাসে আনন্দ ও খুশি প্রকাশ কার উত্তম, ওফাতের জন্য দুঃখ প্রকাশ নয়।'\


No comments:

Post a Comment