ইসলামে পোশাকের বিধান: ১ম পর্ব

মো: হাবীবুর রহমান

     মহাগ্রন্থ আল কোরআনে  ইরশাদ হয়েছে:
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِينَةَ اللَّهِ الَّتِي أَخْرَجَ لِعِبَادِهِ
 'বল! আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের জন্য যে সব শোভার বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা নিষেধ করেছে কে?' (সূরা আ’রাফ : ১৩৮) 

     মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেন:
كُلُوا وَاشْرَبُوا وَالبَسُوا وَتَصَدَّقُوا، فِي غَيْرِ إِسْرَافٍ وَلاَ مَخِيلَةٍ
͑তোমরা খাও, পান কর, পরিধান কর এবং দান কর, তবে অপচয় ও অহংকার পরিহার কর।' ( সহীহ বোখারী; কিতাবুল লিবাস)

     পোশাক-পরিচ্ছদ মানব জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। জীবনের মৌলিক অধিকার ও মনুষ্যের প্রতীক।  পোশাক যেমন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে রাখা ও সৌন্দর্যের উপকরণ, তেমনি শরীয়তের দিক-নির্দেশনা মেনে তা ব্যবহার আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। কোরআন ও সুন্নাহে অন্যান্য বিষয়াদির মতো লেবাস-পোশাক বিষয়েও হুকুম-আহকাম দেওয়া হয়েছে। মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে বিশেষ পার্থক্য হয় এ পোশাকের দ্বারা। আল্লাহ তায়ালা শুধু মানব জাতিকেই পোশাকের নেয়ামত দান করেছেন। 

  মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:

يَابَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ
 'হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করবে। আর অবতীর্ণ করেছি সাজসজ্জার বস্ত্র ও তাকওয়ার পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এতে রয়েছে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে।' (সূরা আরাফ : ২৬) 
আয়াতে পোশাকের তিনটি প্রকার বলা হয়েছে এবং তৃতীয়টিকে তাকওয়ার পোশাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে: আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পোশাকই তাকওয়ার পোশাক। অর্থাৎ পোশাকের মধ্যেও তাকওয়া বা খোদাভীতি প্রকাশ পাওয়া উচিত। তা এভাবে যে, পোশাকে অহঙ্কার বা গর্বের ভঙ্গি যেন প্রকাশ না পায়। বরং তাতে নম্রতার চিহ্ন পরিদৃষ্ট হবে। কেননা, হাদীস শরীফে এসেছে:

مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلاَءَ لَمْ يَنْظُرِ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ القِيَامَةِ
'যে ব্যক্তি অহংকারের সাথে  নিজের পোশাক ঝুলিয়ে চলবে, আল্লাহ তার প্রতি কেয়ামতের দিন (রহমতের) দৃষ্টি দিবেন না।' (সহীহ বোখারী, কিতাবুল লিবাস; হাদীস নং ৫৭৮৪)

পোশাক এমন অাঁটসাট বা পাতলা যেন না হয়, যাতে শরীরের গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দৃষ্টিগোচর হয়।
হযরত আলকামা (রা.) তার মা থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার হাফসা বিনতে আবদুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নিকটে এল। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন।(মুয়াত্তা মালেক ২/৯১৩, হাদীস : ৬)
মহিলাদের পোশাক পুরুষরা এবং পুরুষের পোশাক মহিলারা পরিধান করবে না। কেননা হাদীস শরীফে এসেছে:

لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ
'রাসুলুল্লাহ (দ.) ঐ সব পুরুষদের ওপর লা’নত করেছেন যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারন করে।' সহীহ বোখারী, কিতাবুল লিবাস; হাদীস নং ৫৮৮৫)

শয়তান মানুষের চির দুশমন। সে সর্বপ্রথম জান্নাতে আদম ও হাওয়া (আ.) এর পোশাকের ওপর আক্রমণ করেছিল। যার ফলে তাদের দেহ থেকে জান্নাতি পোশাক খসে পড়ে যায়। 

  মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:

يَابَنِي آدَمَ لَا يَفْتِنَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ كَمَا أَخْرَجَ أَبَوَيْكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ يَنْزِعُ عَنْهُمَا لِبَاسَهُمَا لِيُرِيَهُمَا سَوْآتِهِمَا إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ إِنَّا جَعَلْنَا الشَّيَاطِينَ أَوْلِيَاءَ لِلَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ
 'হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে, যেমন সে তোমাদের মা-বাবাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে। সে তাদের পোশাক খুলে দিয়েছে, যাতে তাদের লজ্জাস্থান দেখিয়ে দেয়। সে এবং তার দলবল তোমাদের এমনভাবে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাওনা। আমি শয়তানকে তাদের বন্ধু করে দিয়েছি, যারা ঈমান আনে না।' (সূরা আরাফ : ২৬-২৭)

মানুষকে পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে পাঠিয়েছেন লক্ষাধিক নবী-রাসুল। তাদের সর্বশেষ আগমন করেছেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (দ.)। তাঁর আনীত ধর্ম ইসলামের প্রতিটি বিধান সর্বকালের সব মানুষের জন্য কল্যাণকর ও সমভাবে প্রযোজ্য। কেয়ামত পর্যন্ত আগত বিশ্বমানবতার জন্য এ মহান ধর্মে রয়েছে চির সুন্দর ও কল্যাণজনক সংস্কৃতি।

  মহাগ্রন্থ আল কোরআনে  ইরশাদ হয়েছে:
صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ
 'তোমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করো। আল্লাহর রঙের চেয়ে উত্তম রঙ আর কার হতে পারে?' (সূরা বাকারা : ১৩৮)। 
আল্লাহর রঙ কী? মহানবী (দ.) তাঁর উম্মতদেরকে হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে বলে দিয়েছেন। তিনি ইসলামের রীতিনীতি পরিহার করে অপসংস্কৃতি গ্রহণ করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন। এ মর্মে হাদীস শরীফে এসেছে:
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
 'যে ব্যক্তি বিজাতিদের রীতিনীতি গ্রহণ করবে, সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে।'(মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খন্ড, হাদীস নং ৫১১৪)

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তথাকথিত সভ্যতা-সংস্কৃতির নামে মুসলিম জাতি আজ গলাধঃকরণ করছে বিজাতিদের রীতিনীতি। মায়ের জাতি নারীদের আজ ব্যবহার করা হচ্ছে পণ্যের মডেলিং ব্যবসায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে এ ধরনের আচরণ আমাদের চিন্তিত করে।

রাসুলুল্লাহ (দ.) কর্তৃক পোশাকের দিক নির্দেশনা হলো:  হাদীস শরীফে  এসেছে: 

وَنَهَانَا عَنْ سَبْعٍ: عَنْ لُبْسِ الحَرِيرِ، وَالدِّيبَاجِ، وَالقَسِّيِّ، وَالإِسْتَبْرَقِ، وَالمَيَاثِرِ الحُمْرِ
'রাসুলুল্লাহ (দ.) অামাদেরকে সাতটি বিষয় নিষেধ করেছেন : রেশমী কাপড়. মিহীন রেশমী কাপড়, রেশম মিশ্রিত কাতান কাপড়, মোটা রেশমী কাপড় এবং লাল মীসারা কাপড় পুরিধান করতে।' (সহীহ বোখারী, কিতাবুল লিবাস; হাদীস নং ৫৭৪৯)

   ১.পোশাকের মূল উদ্দেশ্য সতর আবৃতকরণ এবং সৌন্দর্য অবলম্বন। তাই এমন অাঁটসাট ও পাতলা পোশাক পরা যাবে না, যাতে শরীরের গোপন অঙ্গ ফুটে ওঠে। রাসুল (সা.) বলেন, 'দুই শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামে যাবে। একশ্রেণী, যাদের হাতে গাভীর লেজের মতো বেত থাকবে। আর তারা মানুষকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে। আরেক শ্রেণী, ওইসব নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ। এরা জান্নাতে যাওয়া তো দূরে থাক, জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।' (মেশকাত)। অন্য হাদিসে এসেছে, 'দুনিয়াতে অনেক পোশাক পরিহিত আখেরাতে হবে উলঙ্গ।' (শুয়াবুল ঈমান : ৩০৮৫)।

   ২.পুরুষের পোশাক টাকনুর নিচে পরিধান করা হারাম। রাসুল (সা.) বলেন,

مَا أَسْفَلَ مِنَ الكَعْبَيْنِ مِنَ الإِزَارِ فَفِي النَّارِ
 'ইযারের যে পরিমাণ টাখনুর নিচে যাবে, সে পরিমাণ জাহান্নামে যাবে।' (সহীহ বোখারী, কিতাবুল লিবাস; হাদীস নং ৫৭৮৭)

   ৩. পুরুষের জন্য নারীর এবং নারীর জন্য পুরুষের পোশাক পরা হারাম। 

   ৪.পুরুষের জন্য রেশমের পোশাক পরা জায়েজ নেই। তবে নারীর জন্য সব ধরনের রঙিন পোশাক পরা বৈধ। কেননা, হাদীস এসেছে: 
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ " نَهَى عَنِ الحَرِيرِ
'নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (দ.) রেশম কাপড় ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন।' সহীহ বোখারী, কিতাবুল লিবাস; হাদীস নং ৫৭২৭)

No comments:

Post a Comment